খুব দ্বিধা ও সংকোচের সঙ্গে এই লেখাটা শুরু করছি । কারণ লেখার বিষয়বস্তু - ধর্ম কী ?


'হাতি ঘােড়া গেল তল , ব্যাঙ বলে কত জল'। ধর্ম বিষয়ে ব্যাস - বশিষ্ঠদেব থেকে শুরু । করে বঙ্কিমচন্দ্র - রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত আলােচনা করেছেন , ব্যাখ্যা করেছেন । শ্রীচৈতন্য থেকে শুরু করে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ , রামতীর্থ , দয়ানন্দ , বিবেকানন্দ , প্রণবানন্দ — এত বড় বড় মহাপুরুষ ও ধর্মবেত্তারা আলােচনা করেছেন । তারপর আমার মত এক অতি নগণ্য ব্যক্তি ধর্ম বিষয়ে আলােচনা করার স্পর্ধা রাখে কী করে ? তাই এই সংকোচ । আমি জানি , জ্ঞানীগুণী , বড় বড় পণ্ডিত ব্যক্তিরা এই নগণ্য ব্যক্তি , এই অর্বাচীনের ‘ ধর্ম বিষয়ে লেখা একটা লাইনও পড়বেন না । তাতে ক্ষতি নেই । কারণ , তাদেরকে ধর্ম বােঝানাের জন্য এই লেখা নয় । আজকের বাংলার যুবসমাজকে সঠিক ধর্ম কী ’ এবং ‘ ধর্মটা আসলে কী ? -- একথা বােঝানাের জন্যই এই লেখা । শুধু যুবকদের জন্য আমার এই লেখা উৎসর্গ করলাম । 
 
 ভাইসব , ‘ ধর্ম ' শব্দটা শুনলেই সকলের মনে পূজা , ব্রত , পাঠ , মঠ , মন্দির , ঠাকুর , দেবতা , মূর্তি , মালা , তিলক , ভজন , কীর্তন , উপােস , জপ , যজ্ঞ — এই বিষয়গুলাে স্মরণে আসে । তাই একজন ব্যক্তিকে চন্দনের তিলক কেটে গায়ে নামাবলী দিয়ে কোথাও যাচ্ছেন দেখলে মনে হয় যে উনি নিশ্চয় কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা ধর্মীয় কাজে যাচ্ছেন । একজন মহিলা স্নান করে লালপাড় শাড়ি পরে হাতে নৈবেদ্যের পিতলের থালা নিয়ে যাচ্ছেন । দেখলেই আমাদের মনে হয় যে মহিলাটি নিশ্চয় ধর্মের কোন কাজে যাচ্ছেন । তেমনি ঢাক ঢােল ঘণ্টা বাজিয়ে ঠাকুরপুজো হচ্ছে দেখলে তাে মনে হয়ই যে ধর্মানুষ্ঠান হচ্ছে । ঠিক তেমনি আজকে ধর্মের একটা বড় রূপ হয়েছে — সংকীর্তন , নাম ও জপ । আমাদের বাংলা ও আসামে যজ্ঞ অনুষ্ঠানটা কম । বাকি ভারতে সেটাও প্রচুর । এগুলােকেই সমাজে সাধারণ মানুষ ধর্ম বলে মনে করে । আর তাতেই হয় যত বিপত্তি । আমার মত – ধর্ম সম্বন্ধে এই প্রচলিত ধারণাটিই আমাদের হিন্দুধর্ম ও হিন্দুসমাজের অধঃপতনের মূল ও প্রধান কারণ । মুসলমান নয় , খ্রীষ্টান নয় , কম্যুনিস্ট নয় ।

    আমার যুবক বন্ধুরা , তােমরা এসব বিষয়ে কোন বক্তব্য বা প্রশ্ন নিয়ে জ্ঞানীগুণী পণ্ডিত বয়ােঃজ্যেষ্ঠ গুরুজন বা গুরুদেবদের কাছে যাও । তাঁরা রে রে করে উঠবেন । তাঁদের কাছ থেকে বহু শাপশাপান্ত গালাগালি তােমাদেরকে শুনতে হবে । কারণ , প্রশ্নতে এঁদের বড় অরুচি । এঁরা শুধু শ্রদ্ধা চান আর ভক্তি চান । এঁরা নচিকেতার কাহিনী জানেন । মানেন না । নচিকেতা । একজন বালক হয়েও মৃত্যুর ওপারে কি আছে — যমের কাছে । জানতে চেয়েছিল । শুধু চায়নি , জেদ করেছিল । এবং উত্তর জেনেছিল । ‘ তােমার কথা জানতে নেই ’ — যমরাজার একথা সে মানেনি । তাই নচিকেতাকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল ‘ কঠোপনিষদ ’ । অর্জুন কৃষ্ণের আদেশ এককথায় মেনে নিলে গীতা তৈরিই হত না । অর্জুনের শতখানেক প্রশ্নে ও শ্রীকৃষ্ণ বিরক্ত হননি । এমনকি অর্জুন শ্রীকৃষ্ণের থিওরিটিক্যাল উত্তরে সন্তুষ্ট না হলে কৃষ্ণ তাকে প্র্যাকটিক্যাল ডেমনস্ট্রেশনও দিয়েছিলেন বিশ্বরূপ প্রদর্শনের দ্বারা । প্রশ্নোত্তরের ও তর্ক - মীমাংসার এরকম বহু উদাহরণ আমাদের শাস্ত্রে প্রচুর আছে । আদি শংকরাচার্যের কাজই ছিল বৌদ্ধ পণ্ডিতদের সঙ্গে তর্ক করা । সুতরাং , আমাদের হিন্দু ধর্মে , সনাতন ধর্মে , ‘ প্রশ্ন অতি সম্মানিত , স্বীকৃত ও মর্যাদাপ্রাপ্ত । তাই যুবকভায়েরা , তােমরা ধর্ম বিষয়ে যে কোন প্রশ্ন নিয়ে যদি কোন জ্ঞানীগুণী পণ্ডিত বা গুরুর কাছে যাও , এবং তিনি যদি বিরক্ত হন ও উত্তর দিতে অস্বীকার করে শুধু বিশ্বাস করতে বলেন ও কেবল মেনে নিতে বলেন — তাহলে জানবে যে তিনি আমাদের মহান ধর্মের শ্রেষ্ঠ পরম্পরার অনুগামী নন । তার কাছে ধর্ম শিখবে না ।

   আগে যে কথা বলেছি , পূজা , মালা , তিলক , কাঁসর , ঘন্টা এগুলােকেই শুধু ধর্ম মনে করা চরম ভুল , আমাদের অধঃপতনের মূল কারণ । এগুলি আমাদের ধর্মের একটি অতি ক্ষুদ্র অংশমাত্র । এগুলি আমাদের ধর্মের প্রধান জিনিস নয় , মূল বস্তু নয় । ক্ষুদ্র অংশকেই সব মনে করার ফলে যা বিপর্যয় হতে পারে , তাই হয়েছে । 

  একটা উদাহরণ দেওয়ার চেষ্টা করি । গ্রামের একটা বড় বিয়েবাড়ি । অনেক লােক খাবে । রান্নাবান্না ও পরিবেশনের বিরাট আয়ােজন হয়েছে । একজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যেখানে খাওয়াদাওয়া হবে — সেখানে জল ছেটানাের , যাতে ধুলাে না ওড়ে । সে এত উৎসাহী যে খাওয়ার জায়গায় জল ঢেলে কাদা করে দিল , সব খাবারদাবারের উপরেও প্রচুর পরিমাণে জল ছিটিয়ে দিল । সব খাবার নষ্ট হল ।। আয়ােজন পণ্ড । কেন এমন হল ? কারণ , ধুলাে মারতে জল ছেটানাে যে বৃহৎ আয়ােজনের একটা ক্ষুদ্র অংশ একথা বুঝতে না পেরে সে ওটাকেই কাজের বাড়ির একমাত্র কাজ বা প্রধান কাজ বলে মনে করে সব আয়ােজন নষ্ট করে দিল । 

  আমাদের ধর্মের হয়েছে ঠিক সেই অবস্থা । পূজা - পাঠ , নাম - কীর্তন , ধূপ - ধূনােকেই ধর্ম বলে মনে করায় আসল ধর্ম হারিয়ে গেছে , ধর্মের মূল আয়ােজন , মূল ব্যবস্থা সব পণ্ড হয়ে গেছে । আমাদের সেই মূল ধর্ম , মূল ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে । বলেই অহিন্দু বা সনাতন ধর্ম বিরােধীদের কাছে আমরা বার বার হচ্ছি পর্যুদস্ত , পরাস্ত , অপমানিত , আমাদের ভূমি হচ্ছে ছােট , আমরা নিজ মাটি থেকে হচ্ছি বিতাড়িত । গলায় মালা চন্দন , আর কপালে ‘ রিফিউজি ’ এই লজ্জার চিহ্ন একসঙ্গে শােভা পাচ্ছে । তাহলে মূল ধর্মটা কী ? এটা বােঝা খুব কঠিন নয় । কিন্তু প্রায় হাজার বছর ধরে আমাদের তথাকথিত ধর্মীয় গুরুরা , পণ্ডিতরা ও ইস্পেশাল ’ মর্যাদা দাবী করা ব্রাহ্মণেরা এটাকে গুলিয়ে দিয়েছেন । এখনও ধর্মের ধ্বজাধারীরা , কথাকার , প্রবচনকার ও গুরুঠাকুররা গুলিয়ে দিচ্ছেন । তাই সাধারণ মানুষ সহজে বুঝতে পারছে না — আসল ধর্মটা কী ? মালাতিলক পরে বা না পরে , কাসর ঘন্টা বাজিয়ে বা না বাজিয়ে — যে যেমনভাবে পারে ভগবানকে একমনে ডাকাটাই কি ধর্ম ? না তাও নয় । সেটাও মূল ধর্ম নয় , ধর্মের প্রধান অংশ নয় । ধর্মটা তাহলে কী ? 

  আচ্ছা , এই শব্দগুলির সঙ্গে কি সাধারণ মানুষ খুব অপরিচিত ? —সংসার ধর্ম , গার্হস্থ্য ধর্ম , পিতৃধর্ম , পুত্রধর্ম , পতিধর্ম , পত্নীধর্ম , ধর্মশালা , ছাত্রধর্ম , ধর্মকাঁটা , যেীবনধর্ম , ধর্ম । অস্পাতাল ( বাংলায় নেই , সারা ভারতে আছে ) , যুগধর্ম , প্রজাধর্ম , ক্ষাত্রধর্ম এবং আজকের রাজনীতিতে বহুল প্রচলিত শব্দ ‘ রাজধর্ম । এরকম আরও বহু আছে । এই যে এতগুলি শব্দের সঙ্গে ' ধর্ম ' শব্দটি যােগ হয়ে সমাজে প্রচলিত হয়েছে — এতগুলি ‘ ধর্ম ’ শব্দ তাে মালা তিলক , নাম - জপ , মঠ মন্দিরের সঙ্গেও যুক্ত নেই । তাহলে এগুলােকেই কেন প্রধান ধর্ম বলে মনে করা হয় ? এই যে উদাহরণগুলাে — সংসার , গার্হস্থ্য , পিতৃ , পুত্র , পতি , পত্নী , ছাত্র , ক্ষাত্র , যুগ , যৌবন , রাজা , প্রজা , কাটা ( মালবােঝাই লরি ওজনের যন্ত্র ) , হাসপাতাল , ধর্মশালা — এতগুলাে শব্দের সঙ্গে যে ধর্ম আছে -- এই ১৫ টি শব্দের কোনটাতেই তাে নাম - জপ , কাসর ঘন্টা , ধূপ , ধুনাে , মন্ত্র , তন্ত্র , আহ্নিক কিছুই নেই । তাহলে ধর্ম বলতে এগুলাে সব বাদ , অথচ এগুলােই শুধু ধর্ম হয়ে গেল কী করে ? 

     আমাদের সমাজে এতগুলি শব্দের সঙ্গে ‘ ধর্ম ’ শব্দটি যুক্ত হয়েছে , কারণ , এগুলােই হচ্ছে সমাজের সর্বসাধারণের জন্য করণীয় আসল ধর্ম , প্রধান ধর্ম । এই প্রত্যেকটি শব্দ দ্বারা এক একটি কর্তব্য বা ভূমিকাকে বােঝানাে হয়েছে । আরও স্পষ্ট করে বললে — একটি নির্দিষ্ট ভূমিকায় সুনির্ধারিত কর্তব্যের নাম ধর্ম ।

   উদাহরণ— একটি ১২ বছরের বালক ভাের পাঁচটায় উঠে পড়তে বসল — সে তার ছাত্রধর্ম পালন করছে । বেলা সাড়ে আটটার সময় মা বলল , খােকা , ঘরে সরষের তেল ফুরিয়ে গিয়েছে , দোকান থেকে এক কিলাে তেল নিয়ে আয় । ছেলেটি উত্তর দিল , মা , আমার পড়ার ক্ষতি হবে , আমি এখন দোকান যেতে পারব না , অন্য কাউকে পাঠাও । ছেলেটি তার পুত্রধর্ম পালন করল না । ছাত্রধর্ম পালন করল , কিন্তু পুত্রধর্ম থেকে বিচ্যুত হল । এখন এই বালকটিকে শিক্ষা দিতে হবে যে , কোন ধর্ম কখন কোথায় কতটা পালন করতে হবে । এই শিক্ষার নাম ধর্মশিক্ষা , শুধু গীতার শ্লোক মুখস্থ করানােটা ধর্মশিক্ষা নয় । 

  সুতরাং এককথায় কর্তব্যই হচ্ছে ধর্ম । পিতার কর্তব্য পিতৃধর্ম , মাতার কর্তব্য মাতৃধর্ম , গৃহস্থের কর্তব্য গার্হস্থ্যধর্ম , রাজার কর্তব্য রাজধর্ম , প্রজার কর্তব্য প্রজাধর্ম । প্রতিবেশীর কর্তব্য প্রতিবেশীধর্ম , সমাজের প্রতি কর্তব্য সমাজধর্ম , যুগের কর্তব্য যুগধর্ম । বােঝা খুব কঠিন হচ্ছে কি ?  এটা না বুঝিয়ে আমাদের গুরুঠাকুররা শুধু মুক্তি মুক্তি মুক্তি , ভক্তি ভক্তি ভক্তি করে কান ঝালাপালা করে সাধারণ মানুষকে তার আসল ধর্ম , অর্থাৎ কর্তব্যধর্মটাই ভুলিয়ে দিয়েছেন , গুলিয়ে দিয়েছেন — খুব সৎ উদ্দেশ্যে নয় ।

   অথচ আমাদের শাস্ত্র পুরাণে খুব স্পষ্ট করে বারবার বলা হয়েছে । শিবিরাজার গল্প — শরণাগত পায়রাটিকে আশ্রয় দেওয়াটাই ধর্ম , সেই ধর্ম রক্ষা করতে শিবিরাজা নিজের উরু থেকে পায়রার ওজনের সমান মাংস কেটে দিলেন । আছে মহাভারতে ধর্মব্যাধের গল্প , যেখানে পতিব্রতা নারীকে ও কর্তব্যপরায়ণ ব্যাধকে একজন তপস্বীর থেকেও অধিক ধার্মিক বলে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে । আছে নারায়ণ , নারদ ও কৃষকের গল্প । যেখানে স্বয়ং নারায়ণ নারদের হাতে তেলের বাটি দিয়ে শিক্ষা দিচ্ছেন যে সারাদিন নারায়ণের গুণগান করা নারদের থেকেও দিনে মাত্র দু’বার হরির নাম নেওয়া পরিশ্রমী কর্তব্যপরায়ণ কৃষক নারায়ণের বড় ভক্ত । রাম পিতৃসত্য রক্ষা করতে সত্যধর্ম পালনের জন্য বনে যাচ্ছেন , রাজধর্ম পালনের জন্য সীতাকে পরিত্যাগ করছেন , আবার পতিধর্ম পালনের জন্য পুরােহিতের আদেশ সত্ত্বেও দ্বিতীয় বিবাহ না করে সােনার সীতা পাশে বসিয়ে যন্ত্র করছেন । কৃষ্ণ অর্জুনকে বারংবার তিরস্কার করছেন সে ক্ষাত্রধর্ম বিচ্যুত হচ্ছে বলে । এগুলাে ধর্ম নয় ? 

  এগুলােই ধর্ম । এইসব না শিখিয়ে গুরুঠাকুররা শেখাচ্ছেন - মুক্তিলাভই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য , ভগবদ্ প্রাপ্তি , ভববন্ধন মােচন — এগুলােই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য । আর কী করে এগুলাে হবে ? শুধু গুরুভক্তি দিয়ে আর কয় শুরুর কৃপায় হবে । তাই নিজের বৌ ছেলেমেয়ে , মা বাবা , ঘর ব সংসার সব ভুলে শুধু গুরুর চরণ ধর । গুরু তােমাকে ভবসাগর পার করে দেবেন । এই গুরুঠাকুররা আমাদের শাস্ত্রের নির্দেশ চতুর্বর্গ বা চার পুরুষার্থের কথা জানেন ? মনুষ্য জন্ম নিয়েছ যখন , তখন তােমাকে ধর্ম অর্থ কাম মােক্ষ — এই চার পুরুষার্থ পালন করতে হবে । মােক্ষের কথা ভাববে জীবনের চতুর্থ পর্যায়ে গিয়ে । অর্থাৎ সংসারের সব কর্তব্য সম্পূর্ণ করে , এমনকি কি বাণপ্রস্থ অবস্থায় সামাজিক কর্তব্য পালন করে , যখন আর কোন কর্তব্য বাকি নেই , তখন শুধু সারাদিন ভগবদ্ চিন্তা করবে , মােক্ষ বা মুক্তির কথা ভাববে । তার আগে ভাবলে সব অনর্থ হবে । এই গুরুঠাকুররা কি জানেন না যে শাস্ত্রে বারবার বলা হয়েছে গার্হস্থ্য আশ্রম শ্রেষ্ঠ আশ্রম , এই গার্হস্থ্য আশ্রমই বাকি তিন আশ্রমের আধার । এই গুরুঠাকুররা কি জানেন না আমাদের মহান শাস্ত্রের সেই বিখ্যাত শ্লোক— “ ধৃতি ক্ষমা দম অস্তেয় শৌচম্ ইন্দ্রিয় নিগ্রহম্ ; ধীর্বিদ্যা সত্যম্ অক্রোধ দশকং ধর্মলক্ষণম্ । ” ধর্মের এই শাস্ত্রোক্ত দশটি লক্ষণের মধ্যে পূজাপাঠ , নামজপ , ভগবদ্ভক্তি এসব কোথায় আছে ? শাস্ত্রের এই ধর্মের ব্যাখ্যা কি ভুল ? 

  এসব জানা সত্ত্বেও গুরুঠাকুরা সাধারণ ভক্তিমান ধর্মপ্রাণ মানুষকে সংসারবিমুখ , সমাজবিমুখ করে দিচ্ছেন । ফলে তারা তাদের কর্তব্য করছে না । তার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে চরম বিশৃঙ্খলা । আর এই কর্তব্যহীনতা ও বিশৃঙ্খলার সুযােগ নিচ্ছে বিধর্মীরা , সনাতন ধর্ম বিনষ্টকারীরা । এক মন্দিরে যাওয়া ভক্ত যখন শােনে যে একমাইল দূরে ঐ দেবতারই আর একটা মন্দির ভাঙছে কিছু বিধর্মীরা , তখন এই ভক্তটি সেখানে ছুটে যাওয়ার কর্তব্য অনুভব করে না । সে তখন এই মন্দিরেই দেবতাকে আরও ২৫ বার বেশী করে কপাল ঠুকে প্রণাম করাটাই সংকটমােচনের একমাত্র উপায় বলে মনে করে । কারণ , কোন গুরু - পণ্ডিত ব্রাহ্মণ তাকে শেখায়নি যে বিধর্মীর হাত থেকে মন্দির রক্ষা করতে লাঠি হাতে ছুটে যাওয়াটা ধর্ম । ওই সময় নাম জপ করাটা অধর্ম । এই শিক্ষা নেই বলেই সারা বিশ্বে হিন্দুর মন্দির ভাঙে , মূর্তি ভাঙে , দেবদেবী হয় ব্যাঙ্গের শিকার , হিন্দু নারী হয় গণধর্ষিতা , তবু ভক্তদের হাতের জপের মালা নামে না থামে না , হাতে তন্য কিছু ওঠে না । এরা ভাবে , সবই হরির ইচ্ছায় হচ্ছে । হরিই বাঁচাবেন । এরা নির্বোধ । আমাদের ধর্মের কুশিক্ষা এদেরকে নির্বোধ করেছে । আর এই কুশিক্ষাতে এরা কাপুরুষে পরিণত হয়েছে । হরি কাউকে বাঁচান না । এরা হরির কার্যপ্রণালী কিছুই বোঝে না । সত্যযুগে হরি প্রহ্লাদকে বাঁচিয়েছিলেন । কিন্তু দ্বাপরে কৃষ্ণ তার প্রিয়সখা অর্জুনদের বাঁচানাের জন্যও নিজে একবারও অস্ত্র ধরেন নি । ওদেরকে অনুপ্রাণিত করেছেন — নিজের লড়াই নিজে লড় । আবার এই কৃষ্ণই — তার উপর যত অত্যাচার , অপমান , আক্রমণ হয়েছে , তার প্রতিকারে অর্জুন ভীমকে ডাকেন নি । সে লড়াইগুলাে তিনি নিজে লড়েছেন । পুতনা , অঘাসুর , বঘাসুর , কংস , শিশুপাল — এদেরকে নিজের হাতে মেরেছেন , অন্যের সাহায্য নেননি । অথচ দুঃশাসন , দুর্যোধনকে মারার সময় ভীমকে ইশারায় দেখিয়ে দিয়েছেন , নিজের হাতে গদা তুলে নেননি । সেই কৃষ্ণ এখন হিন্দুর মন্দির ভাঙলে , হিন্দু নারীর ইজ্জত লুষ্ঠিত হলে বাঁচাতে আসবেন ? তিনি আসেননি ১৯৪৬ , ১৯৪৭ , ১৯৫০ , ১৯৬৪ , ১৯৭১ সালে কিংবা ২০০১ সালে ঐ হরিভক্তদের পূর্ববঙ্গে । এই হরিভক্তরা হরির নামের লজ্জা । কাপুরুষ কখনাে কৃষ্ণভক্ত হতে পারে না । 

   ঠিক এইরকম নিষ্ক্রিয়তা , সংসার বিমুখতা , সামাজিক কর্তব্যহীনতা ও passivity ভারতে তৈরি হয়েছিল বৌদ্ধধর্মের প্রসারের ফলে ! এর সুদূরপ্রসারী কুফলের কথা দূরদৃষ্টি দিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন অষ্টম শতাব্দীতে আদিগুরু শঙ্করাচার্য্য । । তখন দেশসুদ্ধ লােক বৌদ্ধবিহারগুলিতে চলে যাচ্ছে ভিক্ষু । আর ভিক্ষুণী হতে । দেশ ও সমাজের সমস্ত ব্যবস্থাগুলি পড়ছে ভেঙে । শঙ্করাচাৰ্য্য বুঝতে পেরেছিলেন এর ফলে যেমন সৃষ্টি হবে সামাজিক অত্যাচার , তেমনি ভেঙে পড়বে দেশরক্ষা ব্যবস্থা ! তাই তিনি সারা দেশ ভ্রমণ করে পুনরায় সনাতন ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । সাধারণ মানুষকে বৌদ্ধধর্মের সংসার বিমুখতা ও কর্তব্যহীনতা থেকে ফিরিয়ে এনেছিলেন সনাতন ধর্মের ব্যবস্থায় । শঙ্করাচার্য্যের সেই দূরদৃষ্টি , পৌরুষ ও সক্রিয়তার ফলেই এ দেশটা বেঁচে গিয়েছে । আজকের আফগানিস্তান ও - পূর্ববঙ্গে বৌদ্ধধর্মের প্রাদুর্ভাবের ফলেই ওই এলাকাগুলি সহজেই ইসলামের বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল । ওই দুই জায়গাতেই আজ তালিবান , জামাত ও হুজিদের বাড় - বাড়ন্ত । 

  আমাদের হিন্দু সমাজের বর্তমানে এই চরম নিষ্ক্রিয়তা , চরম passivity- র জন্য শুধু সাধারণ মানুষ ও ভক্তরাই একমাত্র দায়ী নয় । দায়ী যারা সাধারণ মানুষকে ধর্মের মূল শিক্ষাটা গুলিয়ে দিয়ে কর্তব্যধর্মটা ভুলিয়ে দিয়েছে তারা । আজকের এই বিপন্ন বাঙলায় হিন্দু যুবকদের উদ্দেশ্যে প্রকৃত হিন্দুধর্ম ও কর্তব্যধর্ম বা সম্বন্ধে আমার এটুকুই নিবেদন ।

 হিন্দুর প্রানপুরুষ পূজনীয় তপন ঘোষ  

Comments

Popular Posts